ধর্ষকরা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আশ্রয়-প্রশ্রয় পাচ্ছে

আকাশছোঁয়া ডেস্ক : ধর্ষকরা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আশ্রয়-প্রশ্রয় পাচ্ছে, যার ফলে নির্যাতনের শিকার নারীর পরিবার সঠিক ও সুষ্ঠু বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে হত্যা ও আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটছে অহরহ হচ্ছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।

‘ধর্ষণ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’-এই শ্লোগানকে সামনে রেখে সোমবার (১২ অক্টোবর) বিকেল ৩ টায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে সাম্প্রতিক সময়ে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নারীর ওপর সহিংসতার ঘটনায় সংগঠনের প্রতিনিধিদল কর্তৃক ঘটনাস্থল পরিদর্শন, সরেজমিনে পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা, ধর্ষণসহ সকল প্রকার যৌন সহিংসতা প্রতিরোধ ও ন্যায় বিচার নিশ্চিতের দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে এমনটিই বলা হয়।

আরও বলা হয়, মাদকের সহজলভ্যতা, সমাজের অস্থিরতা,ইন্টারনেটের যথেচ্ছা নেতিবাচক ব্যবহার এবং এই বিষয়ে যথাযথ মনিটরিং ও আইনের প্রয়োগ না থাকা, নারীর প্রতি সংবেদনশীলতার অভাব, প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানসমূহের অসততা, দুর্বলতা, অদক্ষতা,জবাবদিহিতার অভাব নারীর ন্যায় বিচার প্রাপ্তিতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিচার কার্যক্রমের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে নির্যাতনের শিকার নারী ও তার পরিবারের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়না, একই সাথে অপরাধ দমনেও কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব হচ্ছেনা। এ ছাড়া প্রশাসন এবং বিচার কার্যের সাথে জড়িত সকলের জেন্ডার সংবেদনশীলতারও অভাব রয়েছে।

অনুষ্ঠানে মডারেট করেন কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। তিনি বলেন, উন্নয়নের মহাসড়কে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে তবে নারীকে দুর্বল ভেবে তার প্রতি শক্তির প্রদর্শন, মাদকের ব্যবহার, তরুণদের বেকারত্ব বৃদ্ধি, ক্ষমতার অপব্যবহার প্রভৃতি কারণে কারণে দেশে ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি নেতিবাচক অবস্থার সৃষ্টি করছে। তবে এর মধ্যে সরকার কর্তৃক ধর্ষণের ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডের শাস্তির বিধান করে খসড়া আইন প্রণয়ন কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার করে আমাদের জন্য।

কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন সংগঠনের অ্যাডভোকেসি ও লবি পরিচালক জনা গোস্বামী। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সারা দেশে ধর্ষণ, যৌন সহিংসতাসহ নারীর প্রতি সকল প্রকার সহিংসতা ভয়াবহ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসময় তিনি সাম্প্রতিক সময়ে দেশে সংঘটিত কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। সম্প্রতি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনার উল্লেখ করে তিনি বলেন-ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে নির্যাতনের শিকার নারীর বাবা,চাচা ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলা হয়েছে। তাদের খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে এবং বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এর পক্ষ থেকে সবসময় পাশে থাকার আশ্বাস প্রদান করা হয়েছে।এ সময় নির্যাতনের শিকার নারীর বাবা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি জানিয়েছেন।

অন্যদিকে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা বর্ণনায় সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক সম্পাদক রেখা সাহা বলেন, ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে নির্যাতনের শিকার নারীর সাথে দেখা করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করার পরও সম্ভব হয়নি। তবে নির্যাতিতার বাবার সাথে কথা বলে জানা গেছে অপরাধীদের চাপের মুখে থাকায় ঘটনা দেরিতে প্রকাশ পায়।

সংগঠনের লিগ্যাল অ্যাডভোকেসি ও লবি পরিচালক অ্যাড. মাকছুদা আক্তার লাইলী বলেন, দেশজুড়ে ঘটে চলা সহিংসতার ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন নয়। প্রত্যন্ত এলাকায় কাজের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে এলাকা যত দুর্গম হয় তত নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। ওই সকল এলাকার মানুষের চিন্তাধারাও পশ্চাৎপদ হয়। ঘটনার শিকার নারীকে পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়, পরিবারও ঠিকমত যোগাযোগ করতে পারেনা, হয়রানির শিকার হতে হয়। তিনি ধর্ষণের ঘটনা প্রতিহত করতে অপরাধীদের প্রতি এলাকাভিত্তিক গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। ধর্ষণকারীরা কোনো দলের এবং কারো প্রতিবেশী হতে পারে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম, সহ-সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. মাসুদা রেহানা বেগম, সাংগঠনিক সম্পাদক উম্মে সালমা বেগম, আন্তর্জাতিক সম্পাদক রেখা সাহাসহ ঢাকা মহানগরের নেত্রীবৃন্দ, সাংবাদিক এবং সংগঠনের কর্মকর্তাসহ ৪০ জন উপস্থিত ছিলেন।

নারীর সুরক্ষা নিশ্চিতে বেশ কয়েকটি দাবি জানিয়েছে মহিলা পরিষদ। সেগুলো হল-

১. ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে কমিশন গঠন করতে হবে।

২. নারী ও কন্যার প্রতি যৌন নিপীড়নসহ সকল প্রকার সহিংসতা ও নির্যাতন কঠোর হস্তে বন্ধ করতে হবে।

৩. ধর্ষণসহ নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা বন্ধে সরকারকে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করতে হবে।

৪. জরুরি ভিত্তিতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে অপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে হবে।

৫. ধর্ষণের জন্য অভিযুক্তদের দ্রুত বিচারের মাধ্যমে শাস্তি কার্যকর করতে হবে। অপরাধীকে যে কোনো ধরনের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক আশ্রয়- প্রশ্রয়দাতাদের জবাবদিহি, প্রয়োজনে বিচারের আওতায় আনতে হবে।

৬. নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় সংঘটিত অপরাধের জন্য সংসদে জবাবদিহি করতে হবে। জরুরি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে জাতীয় সংসদে, ধর্ষণ বন্ধে করণীয় বিষয়ে আলোচনা উত্থাপন করতে হবে।

৭. বর্তমানে প্রচলিত ধর্ষণ আইনটি আমূল সংস্কার করতে হবে। ধর্ষণের মামলার দীর্ঘসূত্রতা পরিহারের জন্য সুনির্দিষ্ট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে নারী-কন্যাদের প্রতি নির্যাতনকারী ধর্ষণকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৮. ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন ও বিধিমালা তৈরি করতে হবে। ধর্ষণ মামলায় জামিন অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে।

৯. নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার মামলার সাক্ষীর সুরক্ষা ও নিরাপত্তার লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন করতে হবে। উত্ত্যক্তকরণ, যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন রোধে হাই কোর্টের রায়ের আলোকে পৃথক আইন প্রণয়ন করতে হবে।

১০. ধর্ষণের শিকার নারীর ডাক্তারি (মেডিকো-লিগ্যাল) পরীক্ষার ক্ষেত্রে ‘দ্বি-আঙ্গুলের পরীক্ষা’ বা ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হাই কোর্টের রায়ের বাস্তবায়ন করতে হবে।

১১. ধর্ষণের শিকার নারীর ক্ষতিপূরণের জন্য রাষ্ট্রীয় তহবিল গঠন করতে হবে।

১২. নারী ও শিশু নির্যাতন দমন মামলাগুলো মনিটরিংয়ের জন্য তিনটি মন্ত্রণালয়ের (স্বরাষ্ট্র, আইন-বিচার ও সংসদ বিষয়ক এবং স্বাস্থ্য) একটি সমন্বিত মনিটরিং কমিটি গঠন করতে হবে।

১৩. ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিচার ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের, পুলিশ, আইনজীবী (প্রসিকিউশন ও ডিফেন্স), বিচারকদের জেন্ডার সংবেদনশীলতার প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

১৪. পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২ এর বাস্তবায়ন করতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় নারীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

১৫. প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক নেতিবাচক আচার-আচরণ বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষা কার্যক্রমে নারীর মানবাধিকারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

 

শেয়ার করুন :