– জুয়েল আশরাফ
ফুফু কী করছেন?
নীপা অবাক চোখে তাকাল। দশ-এগারো বছরের মেয়ে। ফ্রকের বদলে কামিজ পড়েছে। এই বয়সের মেয়েরা কামিজ পড়লে কেমন বেখাপ্পা লাগে। যদিও বড় মেয়েদের মতো করে নিজেকে সাজাতে যথেষ্ট চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেই চেষ্টায় কোনো লাভ হয়নি। ইশরাকে দেখাচ্ছে সাত বছরের বাচ্চা মেয়েদের মতো। নীপার হাসি পাচ্ছিল, কিন্তু হাসল না। সে বিচলিত ভঙ্গিতে আশেপাশে তাকাল। তার মনে হতে লাগল সময়টা এখন সন্ধ্যা না হয়ে বিকেল হলে ভালো হতো। অনেকদিন আগে নিউমার্কেট থেকে চিনেমাটির চারটা ফুলদানি কিনেছিল। পুরো টাকাটা দেয়া হয়নি। বাকিটা দেওয়ার জন্য বেশ কিছুদিন থেকেই মন উসখুস করছে। অনেকদিন সেই পথে যাওয়া হয় না বলে দেরি হয়ে যাচ্ছে। দোকানদার কি ভাবছে কে জানে! নীপারও কেমন অবাক লাগে, অপরিচিত কাষ্টমারের কাছে এতগুলি টাকা বাকি রাখে কেউ? এখন যদি বাকি টাকাটা সে না দেয়! যদি বছর দুইয়ের মধ্যে নিউমার্কেট না যায় আর? তাহলে দোকানদার তার চেহারা ভুলে যাবে, বাকি ব্যাপারটাও মনে থাকবে না। একদিনের দেখা মাত্র। একদিনের দেখা-চেহারা মানুষ কতদিন আর মনে রাখবে!
‘ইশরা তুই এখন কোথাও যাবি?’
‘না।’
‘পড়তে বসবি এখন?’
‘আমার তো পরীক্ষা শেষ।’
‘আমার সঙ্গে যাবি?’
‘কোথায়?’
‘তোকে চটপটি খাওয়াব, আইসক্রীমও খাবি।’
‘হুঁম যাব।’
‘তোর মাকে বলে আয়। বলবি এক ঘন্টা পর ফিরবি। দেরি হলে চিন্তা না করে।’
‘কিন্তু আমার যে ম্যাডাম আসবে এখন।’
‘তুই তো বললি পরীক্ষা শেষ।’
‘শেষই তো।’
‘তাহলে ম্যাডাম আসবে কেন বলছিস?’
‘মা আসতে বলেছে।’
রিকসায় বসা ইশরার চোখমুখ উজ্জ্বল। আইসক্রীম খাওয়ার আনন্দে নাকি বাইরে ঘুরে বেড়াবার আনন্দে জানে কে! ইশরার মা একটি কাজ ধরিয়ে দিয়েছে। ফেরার সময় স্টিলের দুটি ডাল ঘুটনি কেনার কাজ। নিউমার্কেট এসে নিপা আগে নিজের কাজ সারতে সেই দোকানটির সামনে দাঁড়াল। সেলসম্যান ছেলেটিকে বাকি টাকার কথা বলতেই দোকানের ভেতর থেকে সুন্দর মত এক যুবক বলল, ‘আপনার নাম নীপা? গত মাসে চারটি ফুলদানি কিনেছিলেন?’
নীপা অবাক হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ।’
‘আপনার টাকা একজন দিয়ে দিয়েছে।’
নীপা আগের চেয়ে আরও অবাক হয়ে বলল, ‘কে?’
‘নাম জানি না। তবে আপনার জন্য একটা ছাতা আর একটা কাগজ রেখে গেছে।’
অদ্ভুত ভাবনা আর অনিচ্ছাসত্বেও ছাতাটি হাতে নিল নীপা। শুধু কাগজে এটুকুই লেখা- ‘ফেসবুক মেসেঞ্জারটা খুললে খুশি হব।’
অনেকদিন হলো ফেসবুকে ঢুকে না নীপা। বাড়িতে এসেই লগ ইন করল। রহস্য জানার আগ্রহেই কিনা! অনেকগুলো মেসেজ এসে জমা হয়েছে। সবার মেসেজগুলো পড়ল সে। হাই, হ্যালো, গুড নাইট, কেমন আছো, অনেকদিন দেখি না প্রভৃতির মেসেজের আড়ালে শুধু একজনের ব্যতিক্রম লেখাটা চোখে পড়ল- ‘নীপা কেমন আছেন? আমার পরিচয় জানতে নিশ্চয়ই আপনার মন উতলা হয়ে উঠেছে। হওয়াই স্বাভাবিক। চার বছর ধরে অজানা অদেখা কেউ একজন প্রতি বছরের ঠিক আষাঢ় মাস এলেই আপনাকে ছাতা পাঠায়। এমন ঘটনায় বিচলিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক। আজ কিছু হলেও আপনার চিন্তার ভার নেব। ঘটনাটা শুরু হয়েছিল কোনো এক আষাঢ় মাসেই। প্রচন্ড বৃষ্টিতে ভিজে আমার অসুস্থ মাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ আপনি এসে আমার মায়ের মাথার ওপর ছাতা ধরলেন। এরপর একবারও না তাকিয়ে আমার হাতে ছাতা ধরিয়ে দিয়ে চটজলদি কার ডাকে চলে গেলেন। সেদিন বুঝে ছিলাম অন্যের মায়েদের প্রতিও আপনার তীব্র অনুরাগ! অনেক কষ্ট করে চার বছর আগে আপনার নাম ঠিকানা বের করেছি। অবশ্য আপনার ফেসবুক একাউন্ট পেলাম মাত্র মাস দুই আগে। আপনি রাজি থাকলে আমাদের মাকে দেখাশোনার ভার আমরা দুজনেই নিতে পারি।’
মেসেজ পড়ে নীপা হা হা করে হেসে উঠে একা ঘরেই। কী অদ্ভুত প্রস্তাব! কিন্তু পরক্ষণেই তার ভেতরে অজানা ভাললাগার তীব্র এক অনুভূতি স্পর্শ করল। সে এসে দাঁড়াল বারান্দায়। বৃষ্টির রাত। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে খুব। এখন তো আষাঢ় মাস।