‌’নারীর স্বপ্নগুলো পিছিয়ে পড়ে সুযোগ ও সমাজভীতির কারনে’

গ্রন্থণা: সুরাইয়া নাজনীন-

 

আমাদের জীবনটা অনেক ছোট। আমাদের মনে অনেক আকাঙ্ক্ষা থাকে যেগুলো পূরণ হয় না। কিছুটা সুযোগের অভাবে, কিছুটা সমাজভীতির কারণে। যদি আপনারা স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ পান, চার-দেয়ালের বাইরে এসে নিজের আকাঙ্ক্ষা গুলো পূরণ করার চেষ্টা করবেন এমটাই বললেন মিতা চাকমা। আজ বলবো মিতার উদ্যেক্তা হওয়ার গল্প

 

আপনার শুরুর গল্পটা বলুন-


আমার উদ্যোক্তা হওয়ার যাত্রা শুরু হয়েছিল অনেক আগে। তবে আমি মাঝ পথে ছেড়ে দিয়েছিলাম। এরপর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চাকুরী শুরু করি। তবে চাকুরীতে ঠিক স্বস্তি লাগছিল না। কারন ব্যবসায়ের প্রতি আমার আকর্ষণ যথারীতি বেশি ছিল। কিন্তু অনেক বার উদ্যোগ নিবো নিবো করেও নেয়া হচ্ছিল না। নিজেকে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে দেখা আমার স্বপ্ন ছিল। লক ডাউনের মধ্যে একদিন কে যেন ‘উই’ গ্রুপে আমাকে ইনভাইট পাঠান। আমি একসেপ্ট করি। তখনো আমি তেমন গুরুত্ব দেইনি ‘উই’ গ্রুপে কে। পরে একটা পোস্ট আমাকে আকৃষ্ট করে আর আমি সেই থেকে উই এর পোস্ট পড়তে থাকি আর আমি নতুন ভাবে অনুপ্রাণিত হই। আমার স্বপ্ন কে বাস্তবে রূপ দিতে উই আমাকে উৎসাহিত করে। এভাবে আমার উদ্যোক্তা জীবন শুরু করি।

আপনি অনেক ক্রিয়েটিভ মানুষ, এদেশে ক্রিয়েশনের মূল্যায়ন কতটুকু?

মিতা চাকমার সৃজনশীল পণ্য

মানুষ সবসময় নতুনত্ব কে প্রাধান্য দেয় আর পছন্দ করে। এজন্য ক্রিয়েটিভিটির চাহিদা বর্তমানে বিশ্বে অনেক বেশি। তবে আমাদের দেশের ক্ষেত্রে ব্যাপার টা একটু অন্যরকম। আমাদের দেশে নতুন কিছু করতে গেলে সুবিধার থেকে অসুবিধার মুখোমুখি বেশি পড়তে হয়। আমরা সৃজনশীলতা সহজে গ্রহণ করতে পারি না।
তবে আস্তে আস্তে মানুষের চাহিদা ও পছন্দ পরিবর্তন হচ্ছে। মানুষ এখন অনেক টাই সৌখিন। যার দরুন বর্তমানে ক্রিয়েটিভির গুরুত্ব ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এজন্য আমাদের উদ্যোক্তাদের সবসময় ক্রিয়েটিভ পণ্য তৈরি করার জন্য নতুন নতুন আইডিয়া বের করতে হবে আর বর্তমান প্রেক্ষাপট অনুযায়ী ক্রিয়েটিভ পণ্য আবিস্কার করতে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এখন অনলাইন ভিত্তিক কেনাকাটার প্রসারের জন্য উদ্যোক্তাদের কাছে এক প্লাটফর্মে অনেক কাস্টমার একসাথে পেয়ে থাকেন। এতে কাস্টমার অনেক নতুন নতুন পণ্য ও সেবা পাচ্ছে, সাথে উদ্যোক্তারাও লাভবান হচ্ছেন।

দেশিয় পন্যের গ্রহণযোগ্যতা কেমন?


বর্তমানে দেশিয় পণ্যের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। মহামারির কারণে যেখানে বিদেশি পণ্য চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ হচ্ছে না, সেখানে দেশি পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা আমাদের বাড়াতেই হবে। তাছাড়া বিদেশি পণ্যের দাম দিন দিন বেড়েই চলছে, যা সাধারণ ভোক্তাদের জন্য অসুবিধাজনক।
অনেকের ধারনা, দেশি পণ্য বিদেশি পণ্যের চেয়ে গুণগত মানের দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে। এই ধারনার জন্য দেশিয় শিল্পসহ ছোট ব্যবসার উন্নতি হচ্ছে না আশানুরূপ গতিতে। আমাদের এই ধারনা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। দেশি পণ্য ন্যায্যমূল্যে কেনার মানসিকতা সৃষ্টি করতে হবে।

 

 

একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে টিকে থাকার লড়াই সম্পর্কে বলুন


নারী উদ্যোক্তা হওয়ার চিন্তা করাটাই একটা লড়াইের সমান, টিকিয়ে রাখা তো পরের কথা। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে একবার ব্যবসার ভিত্তি শক্ত হয়ে গেলে ব্যবসায়ী নারী নাকি পুরুষ, সেটা তেমন প্রভাব ফেলে না ব্যবসার ওপর। পক্ষান্তরে এটাও সত্য যে নারী উদ্যোক্তাকে সংসার সামলানোর ব্যাপারে অনিহা করলে চলে না, এক্ষেত্রে নিজেকে ব্যবসায় টিকিয়ে রাখা কিছুটা কঠিন হয়ে ওঠে। কিন্তু আমি মনে করি, একজন নারী সবদিক সামলে চলতে পারে। সবার মধ্যে এই বিশ্বাসটা থাকলে কোন বাধাই নারীকে আটকাতে পারবে না।

তরুণদের উদ্যোক্তা হতে হলে কি কি বিষয় গুরুত্ব দিতে হবে


বর্তমান যুগের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান অভাব এবং উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ধৈর্যশীলতা এবং পরিশ্রম করার প্রবণতা। একটি ব্যবসার ভিত্তিপ্রস্তর মজবুত করতে হলে ধৈর্য নিয়ে পরিশ্রম করে যেতে হবে এবং কাজে পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। নতুন উদ্যক্তাদের হাল ছেড়ে দেয়ার প্রবণতা দূর করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। যদি আপনার সেবা বা পণ্য মানসম্মত হয় এবং আপনার ব্যবসার ধরণ সমসাময়িক ভোক্তার চাহিদা পূরণে সক্ষম হয়, তবে আপনার ব্যবসার প্রসার সুনিশ্চিত।

ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে গুচ্ছ মেলা কতটা গুরুত্ব রাখে


নিজের কাজকে উপস্থাপন করার জন্য গুচ্ছ মেলা অনেক ভালো একটি প্লাটফর্ম। অনালাইন মার্কেট সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক ক্ষেত্র হলেও মেলাগুলোর মাধ্যমে সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়। তাছাড়া ভোক্তা নিজে যাচাই করে নিজের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য বা সেবা গ্রহন করতে পারে। যাদের কাছে নিজের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা কষ্টসাধ্য এবং অনলাইন মার্কেটিং সম্পর্কে পারদর্শিতা কম, বিশেষভাবে তাদের জন্য গুচ্ছ মেলা উদ্যোক্তার আত্মপ্রকাশের একটা ভালো মাধ্যম।

 

একজন নারী উদ্যোক্তা জন্য পারিবারিক সহযোগিতা কতটুকু প্রয়োজন


আমাদের সমাজে একজন নারীর জন্য সংসার ব্যতীত অন্য কোন ক্ষেত্রে নিজের কাজের মূল্যায়ন পাওয়াটা বেশিরভাগ সময় কঠিন হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে পরিবার ছাড়া সমর্থন দেয়ার মতো আর কেউ থাকে না। একজন নারীকে বিয়ের পর নিজের অনেক ইচ্ছা বিসর্জন দিতে হয়। নারীর জন্য সংসার সামলানো আবশ্যক, তবে পরিবার যদি তার ইচ্ছাগুলোকে একটু প্রাধান্য দেয়, একজন নারীও তার জীবনে স্বাবলম্বী ও সচ্ছল হয়ে উঠতে পারে।
আমি অনেক সৌভাগ্যবতী, আমার পরিবার আমাকে সবসময় সব উদ্যোগ নিতে সমর্থন ও সহায়তা করেছে। আমার পরিবারও আমার উদ্যক্তা হয়ে উঠার যাত্রাপথে অনেক ত্যাগ শিকার করেছে। পারিবারিক সমর্থন ছাড়া একজন নারীর উদ্যক্তা হয়ে ওঠা প্রায় অসম্ভব।

চাকরি এবং ব্যবসা, কোনটি প্রাধান্য পাবে আপনার কাছে?


চাকরি এবং ব্যবসা, উভয়ের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা ও অসুবিধা আছে। চাকরিতে একটা নির্ধারিত বেতন থাকে এবং ঝুঁকি নেই বললেই চলে, তবে চাকরিতে নিজের সৃজনশীলতা প্রকাশের সুযোগ কম। অন্যদিকে ব্যবসায় নতুনত্ব ও উৎসাহ অনুযায়ী কাজ করা যায়, যদিও নতুন ব্যবসায় ঝুঁকি সবসময় নিতে হয়।
আমার জন্য ব্যবসা করা অপেক্ষাকৃত বেশি অনুকূল। কারন আমি বাধা-ধরা নিয়মের মধ্যে চাকরি না করে নিজের বুদ্ধি ও পরিশ্রম কাজে লাগিয়ে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করা বেশি তৃপ্তিকর মনে করি। তাছাড়া ব্যবসা করা আমার স্বপ্ন, তাই আমি এটাকেই বেশি প্রাধান্য দেই।

 

বর্তমানে অনলাইন পণ্যের অভাব নেই, ঠিক কোন বিশেষত্বের কারণে আপনার পণ্যটি গ্রহণযোগ্য হবে


অনলাইনে কেনাকাটার ব্যাপারে ভোক্তা দুইটি ব্যাপারে বেশি শঙ্কিত থাকে। প্রথমত, পণ্য বা সেবা মানসম্মত কিনা; দ্বিতীয়ত, ভোক্তা পণ্য বা সেবার বদলে প্রতারণার শিকার হবে কিনা। আমরা আমাদের পণ্যের মান নিয়ে কোন সমঝোতা করি না। অনলাইনের হাজারো পণ্যের ভিড়ে আমরা সবচেয়ে ভালো জিনিস ভোক্তাকে দেয়ার চেষ্টা করি। অন্যদিকে, আমাদের সাথে ভোক্তার মধ্যকার স্পষ্ট কথোপকথন ও পণ্য বিতরণের সুবিধাজনক ব্যবস্থা থাকার কারণে আমাদের বিশ্বস্ততা নিয়ে ভোক্তার কোনো শঙ্কা থাকে না।

একজন হারিয়ে যাওয়া কিংবা পিছিয়ে পড়া উদ্যক্তার জন্য উঠে আসার শক্তি কি হতে পারে


একজন প্রকৃত উদ্যক্তা হতে হলে নিজের ওপর ভরসা রাখা শিখতে হবে। একটি উদ্যোগে পিছিয়ে পড়লে যে হাল ছেড়ে দিয়ে নিজের ভাগ্যকে দোষ দিতে থাকবেন, তা মটেও উচিৎ নয়। নতুন করে আবার শুরু করতে হবে, নাহলে অন্য একটি নতুন উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। সবাই সব ক্ষেত্রে সফল হবে, এমন কোন কথা নেই। আপনাকে বুঝতে হবে আপনি কোন ক্ষেত্রে নিজের সৃজনশীলতা কাজে লাগিয়ে একটি সফল ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। এভাবে এগিয়ে যেতে থাকলে একদিন অবশ্যই সফলতা পাবেন।

ধন্যবাদ আপনাকে, পাঠকদের উদ্দেশ্য কিছু বলতে পারেন


আমি বিশেষভাবে নারী পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চায়। আমাদের জীবনটা অনেক ছোট। আমাদের মনে অনেক আকাঙ্ক্ষা থাকে যেগুলো পূরণ হয় না। কিছুটা সুযোগের অভাবে, কিছুটা সমাজভীতির কারণে। যদি আপনারা স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ পান, চার-দেয়ালের বাইরে এসে নিজের আকাঙ্ক্ষা গুলো পূরণ করার চেষ্টা করবেন। সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

শেয়ার করুন :