ফ্যাশনে আমাদের আবিষ্কার নেই: সুমী

সুরাইয়া নাজনীন

মৌমাছি মৌমাছি কোথা যাও নাচি নাচি, একবার দাঁড়াও না ভাই। মৌমাছির আজ দাঁড়াবার সময় নেই। রঙিন ক্যানভাসে ফুলেরা, পাখিরা, মৌমাছির দল ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছে। প্রকৃতিতে নয়! আকিঁবুকিতে। আফসানা সুমীর ভাবনাগুলো এমনই। তিনি একজন উদ্যক্তা। ‘গুটিপোকার’ স্বত্বাধিকারী। সবসময় শিল্পের মাধুরিতে কাজ করেন আপন মনে। কথা হলো আফসানা সুমীর সঙ্গে-

আপনার শুরুটা বলুন?
শুরুর গল্পটা অনেক অনেক আগের। সেই ছোটবেলা থেকেই আকাঁ আকিঁর প্রতি নেশা। পড়ায় ফাকিঁ দিয়ে ছবি আকঁতাম। সবসময়ই বকা খেতাম এজন্য। মায়ের নকশা করা জামা আর আমার একটু আধটু তুলির আচড়, এভাবেই কাটছিল দিন। বন্ধুদের জামাতেও একেঁ দিতাম, ইডেনের হলে বসে এক্রেলিকে তুলি ডুবিয়ে এই একটা শখের চর্চাই করা হত আমার।
সেই সময় বন্ধুরা মিলে প্রথম একটি উদ্যোগ নিই। ৪ জনের অর্থ বিনিয়োগ, আমার ডিজাইন আর সেই ডিজাইন পোশাকে সবাই মিলে তুলে আনা এই ছিল প্লান। নানান কারণে সেই উদ্যোগ অসফল হয়।
দীর্ঘসময় পেরিয়ে ২০১৩ সালের ২২ জুলাই গুটিপোকার জন্ম হয়। এর আগে ২ বছর চাকরিও করেছিলাম, মাস্টার্স পরীক্ষার সময় ছেড়ে দিই। একাউন্টিং এ অনার্স মাস্টার্স করেছি, ব্যাংকার হওয়াই ছিল জীবনের লক্ষ্য। আমার শখের উদ্যোগকে প্রফেশনে পরিণত করেন ক্রেতারা, বন্ধুরা। তাদের উৎসাহ, অনুপ্রেরণা, প্রশংসা আমাকে আত্মবিশ্বাস দেয়। এক সময় ভাবতে শিখি, নাহ চাকরি নয়, নিজ প্রতিষ্ঠানে ছবি আকাঁই হবে আমার পেশা।

আফসানা সুমী

আপনি অনেক ক্রিয়েটিভ মানুষ, এদেশে ক্রিয়েশনের মূল্যায়ন কতটুকু?
ক্রিয়েশনের মূল্যায়ণ আছে আবার নেই। বাংলাদেশে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি এখনো সেভাবে ডেভলপ করেনি। মানুষ অনেক বেশি পাশ্চাত্য ও ইন্ডিয়ান স্টাইল ফলো করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। নিজের নকশা বলতে টিভিতে দেখা নকশাকে একটু এদিক সেদিক করে করাকেই বোঝে। ফ্যাশনে আমাদের আবিষ্কার নেই, সবই আগে কারও করা। অর্থাৎ সবাই প্রভাবিত নকশা নিয়েই ডিজাইনার। সেক্ষেত্রে ক্রেতাও সেরকম, মূল্যায়নও সেরকম। দেশে যদি আরও বিবি রাসেল থাকতেন, আমাদের নিজস্ব ধারার চর্চা যদি আরও বাড়ত, তাহলে ক্রিয়েশনের মূল্যায়ণও বাড়ত।
এরই মাঝে আমার কাজ হ্যান্ড পেইন্ট নিয়ে, অর্থাৎ আমি পোশাকে আকিঁ। প্রকৃতি থেকে প্রেরণা নিয়ে, যথাসম্ভব অপরের প্রভাব কাটিয়ে কাজ করি। সম্মান অবশ্যই পাই। এখন সবার সম্মান তো পাব না, কত রকমের মানুষ আছে৷ কেউ ঈর্ষা করবে, কেউ শিল্পমূল্য দিতে না পেরে রাগ করবে, কেউ কপি করবে। এই নিয়েই আছি।

দেশিয় পণ্যের গ্রহণযোগ্যতা কেমন?
দেশিয় পণ্যের গ্রহণযোগ্যতা দিনে দিনে বাড়ছে। আমি উইমেন এন্ড ই-কমার্স ফোরামের সদস্য। এখানে নিয়মিত দেশি পণ্য ক্রয় করতে উৎসাহ দেওয়া হয়, এর মান গুণ বৈচিত্র তুলে আনা হয়। মানুষ অনেক অচেনা পণ্যকে চিনছে, কিনছে। ঘরের কাছে সমাধান পেলে কেউ কেনই বা বাইরে যাবে, তাই না?

একজন নারী উদ্যক্তা হিসেবে টিকে থাকার লড়াই সম্পর্কে বলুন
আমি আসলে নিজেকে নারী হিসেবে আলাদা করে কখনো ভাবিনি। যা করতে চেয়েছি তা শুধু করে গেছি। আমার মা সবসময় আমার পথ চলার সংগী ছিলেন। তবু চাকরি না করার মতো সিদ্ধান্তে অটল থাকতে বেগ পেতে হয়েছে বৈকি। আমি কোনো বাধাঁকেই কখনো আমলে নিই নি। আর্থিক সংকট, জীবনের টানাপোড়েন সব একলা সামলেছি, তাই সিদ্ধান্তগুলো একলা নেওয়ার সাহস ছিল। এই সাহসই আমাকে পথ দেখিয়েছে।

তরুনদের উদ্যক্তা হতে হলে কি কি বিষয় গুরুত্ব দিতে হবে?
সবার আগে তাদের জানতে হবে কি নিয়ে তারা কাজ করতে চান, সেই বিষয় তাদের হাতের মুঠোয় আছে কিনা! নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে অন্তত ৩ বছর উদ্যোগ থেকে আয় না এলেও তারা লড়াইটা করতে পারবেন কিনা।

 

ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে গুচ্ছ মেলা কতটা গুরুত্ব রাখে?
গুচ্ছ মেলা তো খুবই ভালো। আমরা তো অনলাইন ব্যবসায়ী। মেলা হলে অফলাইনে ক্রেতাদের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ হয়, হৃদ্যতা বাড়ে। উদ্যোক্তাদের মাঝেও বন্ধন দৃঢ় হয়।

একজন নারী উদ্যক্তার জন্য পারিবারিক সহযোগিতা কতটুকু প্রয়োজন?উদ্যোক্তার জন্য পারিবারিক সহযোগিতা থাকা খুবই জরুরি। যে এই সহযোগিতা পাবে সে অনেক দ্রুত এগিয়ে যাবে। তবে আমাদের দেশে সহযোগিতা পাওয়াটা দুস্কর। দিনশেষে একজন উদ্যোক্তা আসলে একা। তার ঝুকিঁটা তাকেই বহন হয়, হেরে যাওয়া রাতগুলো একাই কাটাতে হয়।

চাকরি এবং ব্যবসা,, কোনটি প্রাধান্য পাবে আপনার কাছে?

চাকরি ও ব্যবসা উভয়ই সমাজের জন্য প্রয়োজনীয়। যে যেটা করে জীবনে উন্নতি করতে পারবে সে সেটাই করবে। যার পক্ষে চাকরি করে প্রমোশন নিয়ে উচু পদে বিরাজ করা সম্ভব তার অবশ্যই সেটাই করা উচিত। আবার ব্যবসা করে যদি সে এর চেয়েও সফলতা অর্জন করতে পারবে মনে করে তাহলে সে ব্যবসা করবে। সহজ হিসেব আমার।

শেয়ার করুন :