আকাশছোঁয়া ডেস্ক : সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ মঙ্গলবার। গত বছরের এই দিনে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অবিভক্ত ভারতের কোচবিহার জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। পরে তার পরিবার রংপুরে চলে আসে। রংপুরেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে ১৯৫২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এরশাদ। ১৯৬৯ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি পেয়ে ১৯৭১-৭২ সালে সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ওই বছরই আগস্ট মাসে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে তাকে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে এরশাদকে সেনাবাহিনী প্রধান পদে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৭৯ সালে তিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন। ১৯৯১ সালে এরশাদ গ্রেফতার হন। ১৯৯১ সালে জেলে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় এরশাদ রংপুরের পাঁচটি আসনে বিজয়ী হন। ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনেও এরশাদ সংসদে পাঁচটি আসনে বিজয়ী হন। ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি জামিনে মুক্ত হন। ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এরশাদের জাতীয় পার্টি ১৪টি আসনে জয়ী হয়। ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গে মহাজোট গঠন করেন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে তার দল ২৭টি আসনে বিজয়ী হয়। এরপর দশম ও চলতি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি চলতি জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা ছিলেন।
জেনারেল থেকে তাঁর রাজনীতিক হওয়ার গল্প
ক্ষমতা দখলের পর দেশে রাজনীতি নিষিদ্ধ করে তিনি বাংলাদেশে দ্বিতীয় বারের মতো সামরিক শাসন জারি করে নিজেকে প্রধান সামরিক শাসক হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন।
তিনি নতুন এক শ্লোগান চালু করেছিলেন, সেটি ছিল ”নতুন বাংলাদেশ, গড়ব মোরা…।”
তিনি তাঁর সেই শ্লোগান দিয়ে গানও লিখেছিলেন।
তবে তাঁর সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করেছিলেন ছাত্ররা।
তিনি ১৯৮৬ সালের শুরুতে বিভিন্ন দল থেকে মিজানুর রহমান চৌধুরী, শাহ আজিজ এবং মওদুদ আহমেদসহ অনেক রাজনীতিককে নিয়ে জাতীয় পার্টি নামের দল গঠন করেন। সেই দল থেকে মনোনয়ন নিয়ে তিনি নির্বাচন দিয়ে রাষ্ট্রপতি হন। এরই মাঝে রাজনৈতিক দলগুলো তাঁর বিরুদ্ধে যৌথভাবে আন্দোলন শুরু করেছিল।
জেনারেল এরশাদ তখন সেই ১৯৮৬ সালে সংসদ নির্বাচন করেছিলেন। সেই সংসদ মাত্র এক বছর টিকেছিল। ১৯৮৮ সালে তিনি মূল ধারার দলগুলোর বয়কটের মুখে একতরফা নির্বাচন করলেও তিনি বেশিদিন টিকে থাকতে পারেননি। দুই বছর পরই আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং বামপন্থী দলগুলোর অর্থ্যাৎ তিনি জোটের গণআন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর জেনারেল এরশাদের শাসনের পতন হয়।
তাঁর শাসনের সময় আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে অনেকে নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে নূর হোসেন এবং ডা: মিলনের নাম এখনও মুখে মুখে উচ্চারিত হয়।
জেনারেল এরশাদের পতনের দিনটি স্বৈরশাসকের পতন দিবস হিসেবে এখনও বিভিন্ন দল ও সংগঠন পালন করে থাকে।
তিনি মোট নয় বছর ক্ষমতায় ছিলেন।
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম
জিয়াউর রহমান যেমন ১৯ দফা কর্মসূচি নিয়েছিলেন, তার আদলে জেনারেল এরশাদ ১৮ দফা উন্নয়নের কর্মসূচি নিয়ে রাজনীতিতে নেমেছিলেন। তিনি ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলেছিলেন এবং দেশকে কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। কিন্তু তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি।
হাইকোর্ট বা উচ্চ আদালতকে রাজধানী ঢাকার বাইরে অন্য বিভাগীয় শহরগুলোতেও স্থানান্তরের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, বিরোধীতার মুখে সেই উদ্যোগও ব্যর্থ হয়। তাঁর সময়ই প্রথম উপজেলা এবং জেলা পরিষদ গঠিত হয়েছিল। তাঁর ক্ষমতার শেষদিকে উপজেলা নির্বাচনও হয়েছিল।
তাঁর এই পদক্ষেপগুলোকে বিশ্লেষকদের অনেকে ইতিবাচক হিসেবে বর্ণনা করেন। তাঁর সময়ে ১৯৮৮ সালে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী আনা হয়েছিল। তখন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি-প্রধান দুই দলই এর বিরোধীতা করেছিল। কিন্তু পরে কোন দলই আর এর পরিবর্তন করেনি। এরশাদ সরকারের একজন প্রভাবশালী নেতা, যিনি এখন অন্য রাজনৈতিক দলে আছেন, তিনি বলেন যে রাজনৈতিক সংকট সামাল দেবার জন্য একটি কৌশল হিসেবে মি: এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করেন।
রাজনীতিতে তাঁর প্রভাব
জেনারেল এরশাদের শাসনের পতনের পর তাঁকে জেলে নেয়া হয়েছিল। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা এবং দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে ডজনখানেক মামলা হয়েছিল। ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র আবার ফিরে আসার পর তিনি জেলে থেকেই সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। সেই পরিস্থিতিতে তাঁর দল জাতীয় পার্টি ৩৫টি আসন পেয়েছিল। তিনি রংপুরের পাঁচটি আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপরের সংসদ নির্বাচনগুলোতে তিনি নিজে কখনও পরাজিত হননি।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর তিনি জেলে থেকেই আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের জন্য সমর্থন দিয়েছিলেন।তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ছয় বছর জেল খাটার পর জেনারেল এরশাদ জামিনে মুক্তি পেয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে মামলাগুলোর কয়েকটিতে তিনি দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। কোনটিতে খালাসও পেয়েছেন। এসব মামলার কারণে তিনি স্বাধীন অবস্থান নিয়ে রাজনীতি করতে পারেন নি। জাতীয় পার্টি কয়েকটি ভাগে বিভক্তও হয়েছে।
এরপরও ভোটের রাজনীতিতে তাঁর দল জাতীয় পার্টির একটা অবস্থান তৈরি হয়। রংপুর অঞ্চলের ১৭টি আসনে জাতীয় পার্টির ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। নির্বাচন এলেই আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি – প্রধান দুই দলই তাঁকে সাথে নেয়ার চেষ্টা করে। তবে গত কয়েকটি নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের সাথেই থাকতে হয়েছে। জাতীয় পার্টি গত কয়েকটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাথে জোট থেকে অংশ নিয়েছে। যদিও দলটি তাদের দলীয় প্রতীক লাঙল নিয়ে লড়েছে।